ক্লিওপেট্রাঃ এক রহস্যময়ী নারীর ইতিবৃত্ত জানুন।
November 02, 2022
0
মাত্র ৩৯ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে কখনো ছিলেন রাজকন্যা, কখনো বা পরাক্রমশালী রানী, আর কখনো তিনি ছিলেন প্রেয়সী। ক্লিওপেট্রা কে মনে করা হয় সম্মোহনী সৌন্দর্য্য আর সীমাহীন ক্ষমতার সত্বাধিকারী। রুপালি পর্দায় তাঁকে রুপসী হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে, পরমাসুন্দরী হিসেবে তার খুব বেশি খ্যাতি ছিল না। তবে তাঁর তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা, মন্ত্রমুগ্ধকর ব্যক্তিত্ব, সহজাত রসবোধ,প্রচণ্ড উচ্চাভিলাষ ও তা বাস্তবায়নের অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে তিনি সর্বকালের সেরা মহিলাদের কাতারে স্থান করে নিয়েছেন। ক্লিওপেট্রাকে ঘিরে ইতিহাসে বিতর্ক আর রহস্যের যেন শেষ নেই। যেমন রহস্যময তার জীবন ও রাজ্য শাসন, তেমনি রহস্যময় তার প্রেম। তাঁকে নিয়ে গল্প-কবিতা-উপন্যাসের পাশাপাশি নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রও।উইলিয়াম শেক্সপিয়র, জর্জ বার্নাড শ, জন ড্রাইডেন, প্লুটার্ক, হেনরি হ্যাগার্ড, ড্যানিয়েল– প্রত্যেকেই আলাদাভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর চরিত্র। হ্যালিওয়েল তাকে ‘দ্য উইকেডেস্ট উইম্যান ইন দ্য হিস্ট্রি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
প্রেম আর মৃত্যু এই নারীর জীবনে একাকার হয়ে গেছে। তিনি যেমন ভালোবাসার উদ্যাম হাওয়া বইয়ে দিতে পারতেন, তেমনি প্রয়োজনে মারাত্মক হিংস্র হতেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করতেন না।
দান্তের মতে, লালসার শাস্তি হিসেবে তিনি নরকের দ্বিতীয় স্তরে দাউ দাউ করে পুড়ছেন। কারো কারো দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন ‘সারপেন্ট অব দ্য নাইল’। অনেকে আবার তাঁর আবেদনময়ী দিকটিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। ফারাও রাজবংশের সর্বশেষ রাণী ক্লিওপেট্রা শুধুমাত্র মিসরীয় ইতিহাসের এক বিস্ময়কর নামই নন, ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত নারীদের মধ্যেও তিনি একজন।
ক্লিওপেট্রাঃ
খ্রিস্টপূর্ব ৬৯ সালে প্রাচীন মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় জন্ম ক্লিওপেট্রার।তার পুরা নাম ক্লিওপেট্রা সপ্তম ফিলোপেটর। মেসিডোনিয়ান বংশোদ্ভূত সপ্তম মিসরীয় রানী হওয়ায় তাকে এই পরিচিতি বহন করতে হয়। গ্রিক শব্দ kleos আর pater থেকেই ক্লিওপেট্রা। যার স্ত্রী বাচক অর্থ করলে দাঁড়ায় “গ্লোরী অফ দ্য ফাদার“।তার আগে আরো ছয়জন কিওপেট্রা ছিলেন।তার পূর্বপুরুষ টলেমি ছিলেন মহামতি আলেক্সান্ডারের একজন সেনাপতি। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ সালে আলেক্সান্ডার মারা গেলে তার অন্যতম সেনাপতি টলেমি মিসরে স্বাধীন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। কিওপেট্রা এই বংশেরই শেষ শাসক। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মিসরে প্রায় ৩০০ বছরের মেসিডোনিয়ান শাসনের অবসান ঘটে। তার মায়ের দিককার পরিচয় অবশ্য পাওয়া যায় না। এ কারণে তিনি রোমানদের মতো শ্বেতাঙ্গ ছিলেন, নাকি মিসরীয়দের মতো কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন, তা জানা যায়নি।অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৫১ অব্দে রোম সম্রাট টলেমি অলেতিস মারা যান। মারা যাওয়ার আগে তার বিশাল সাম্রাজ্য ১৮ বছর বয়সী কন্যা ক্লিওপেট্রা [ক্লিওপেট্রা-৭] ও ১o বছর(কারো কারো মতে ১২ বছর) বয়সী পুত্র টলেমি-১৩-কে উইল করে দিয়ে যান। সেই সঙ্গে মৃত্যুর সময় রোমান নেতা পম্পে-কে রাজ্য ও তার সন্তানদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখনকার মিসরীয় আইন অনুসারে দ্বৈত শাসনের নিয়মে রানী ক্লিওপেট্রার একজন নিজস্ব সঙ্গী থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। কাজেই ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করতে হয় তারই ছোটভাই টলেমি-১৩ কে, যখন টলেমির বয়স ছিল মাত্র ১০বছর (কারো কারো মতে ১২ বছর)। ফলে আইনগতভাবে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পিত হলো ক্লিওপেট্রা এবং তার স্বামী (ওরফে ছোট ভাই) ত্রয়োদশ টলেমির উপর। ক্ষমতায় আরোহণের পর নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও ক্লিওপেট্রা তার শাসন চালিয়ে গেলেন।
ধারণা করা হয় কিওপেট্রার বড় দুই বোনের একজন (ক্লিওপেট্রা ষষ্ঠ) শৈশবেই মারা গিয়েছিলেন ও অপরজনকে (বেরেনিস) টলেমি অলেতিস-ই হত্যা করেছিলেন। এ ছাড়া ক্লিওপেট্রার ছোট আরো দু’টি ভাই ছিল।
সে সময়ের মুদ্রায় অঙ্কিত ক্লিওপেট্রার প্রসন্ন ভাব, স্পর্শকাতর নিখুঁত গ্রিসিয়ান মুখাবয়ব, গোলাকার দৃঢ় চিবুক, ধনুকের মতো ঢেউ খেলানো ভুরু যুগলের নিচে অনিন্দ্য সুন্দর চোখ, প্রশস্ত ললাট আর সুতীক্ষ্ম নাসিকার চমৎকার সমন্বয় দেখা যায়। সৌন্দর্যে ঘাটতি থাকলেও প্রখর বুদ্ধিমত্তা, যেকোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা, সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব তাকে করেছিল তুলনাহীন। তবে ক্লিওপেট্রা ও টলেমি-১৩ এর মধ্যকার সুসম্পর্ক স্থায়ী হয়নি। সিংহাসনে বসার মাস কয়েক পরেই দু’জনের মধ্যকার সম্পর্কে ফাটল ধরে। ক্লিওপেট্রাও সব সরকারি দলিলপত্র থেকে তার ভাইয়ের নাম মুছে ফেলতে থাকেন। এমনকি মুদ্রায় তার একক পোর্ট্রেট ও নাম সংযোজন করেন। তবে তিনিও টিকতে পারেননি। দুর্ভিক্ষ, বিশৃঙ্খলা, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ফলে ক্লিওপেট্রাকেও সরে যেতে হয় ক্ষমতা থেকে। কিন্তু তিনি দমে যাননি মোটেও ধারণা করা হয় বোন আরসিনোইকে নিয়ে আরব সৈন্যদের সহায়তায় তিনি সিরিয়ায় চলে যান এ সময়।
ক্লিওপেট্রা ও জুলিয়াস সিজারঃ
এরই মধ্যে ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ফারসালুসের যুদ্ধে( রোমের গৃহযুদ্ধ) দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাপতি পম্পে পরাজিত হলেন। রোমের গৃহযুদ্ধের নায়ক হিসেবে অনেকাংশেই দায়ী করা হয় পম্পেকে। জনসাধারণকে তিনি বুঝিয়েছিলেন, সিজার ও তার পৃষ্ঠপোষকরা ভীষণ অবিচার করেছেন পম্পের পিতাকে অকারণে হত্যা করে। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে তার সিজারের বিরুদ্ধে তার এই বিদ্রোহ। সিজার শুনতে পেলেন, তার বিরোধীরা দল বেঁধে পম্পের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। সিজার কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত তার একান্ত বিশ্বস্ত লেপাডাইসের সঙ্গে পরামর্শ করে একজন দূতকে পাঠালেন মিসরে। অনেক টানাপড়েন সত্ত্বেও সফল হলেন তিনি। খ্রিস্টের জন্মের ৪৯ বছর আগে যে গৃহযুদ্ধের সূচনা, তার সমাপ্তি ঘটল পম্পের পরাজয়ে। পম্পে পালিয়ে গেলেন ক্লিওপেট্রার দেশ আলেকজান্দ্রিয়ায়। সিজার তার অনুচরদের আদেশ দিলেন যে করেই হোক পম্পেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে। ওঁত পেতে রইল তারা। সে বছরই আলেকজান্দ্রিয়ায় সিজারের অনুচররা ছুরিকাঘাতে হত্যা করল পম্পেকে। এর চার দিন পর সিজার বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে মিসরে পৌঁছালেন। মিসর-সম্রাট টলেমি তাকে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলেও সফল হতে পারেননি। ক্লিওপেট্রাও পুরো ঘটনার ওপর তীক্ষ্ম নজর রাখছিলেন। তিনি সুযোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি দেখলেন সিজার শক্তিশালী এবং সেই সাথে একনায়ক। সবচেয়ে বড় কথা তার ওপর নির্ভর করা যায়। তার সহায়তায় ক্লিওপেট্রা আবার রাজক্ষমতা ফিরে পাওয়ার উদ্যোগ নেন। এ সময় সিজারের চাহিদা ছিল সম্পদের,আর কিওপেট্রার ক্ষমতার। দু’জন দু’জনের পরিপূরক হিসেবে অবস্থান নিলেন। এতে দু’জনই লাভবান হলেন। সিজারের সাথে ক্লিওপেট্রার সাক্ষাতের ঘটনাটিও বেশ আকর্ষণীয়। আলেক্সান্দ্রিয় ার রাজপ্রাসাদে সিজারের পাহারায় ছিল ক্লিওপেট্রার স্বামী-ভাইয়ের বাহিনী। ফলে পরিচয় প্রকাশ করে সিজারের কাছে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। তাই কৌশল গ্রহণ করলেন। এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে হাত করলেন তিনি। এক দিন সিজারের সামনে মুঁড়ানো কয়েকটি কার্পেট আনা হলো। একে একে সবগুলো খোলা হলো সিজারের সামনে। সেগুলোরই একটির ভেতর থেকে নাটকীয়ভাবে বেরিয়ে এলেন ক্লিওপেট্রা। তার বুদ্ধিমত্তা আর সৌন্দর্যের সামনে হেরে গেলেন রোমান সম্রাট। কী ঘটতে যাচ্ছে টলেমি ত্রয়োদশ ঠিকই বুঝতে পারলেন। তিনি নগরবাসীকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু এবারেও ব্যর্থ হলেন। পরিণতিতে তাকে নীল নদে ডুবিয়ে দেয়া হলো। অবশ্য তার আগে থেকেই মিসরের ব্যাপারে রোমান শাসকেরা নাক গলাতে শুরু করেছিল। ক্লিওপেট্রার পিতাও রোম সম্রাটের সাহায্যে ক্ষমতা পুনর্দখল করেছিলেন। অনেকের মতে, সিজার চেয়েছিলেন ক্লিওপেট্রাকে মিসরে রোমের বশংধর হিসেবে রাখতে। সমঝোতা হিসেবে কিওপেট্রা তার অপর ভাই টলেমি চতুর্দশকে বিয়ে করেন (তা স্থায়ী হয়েছিল ৪৭-৪৪ খ্রিষ্টপূর্ব পর্যন্ত)। এই বিয়েটা হয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়াবাসী ও মিসরের পুরোহিতদের খুশি রাখতে। কারণ বিয়ে সত্ত্বেও একই সাথে তিনি সিজারের মিসরে অবস্থানকালে তার প্রেমিকা হিসেবেও বহাল থাকেন। চাঁদনি রাতে বজরায় করে দুইজনে নীলনদে ভেসে বেড়ান। সিজারের এক পুত্রসন্তানের জন্মও দেন তিনি। তার নাম রাখা হয় সিজারিয়ান (ছোট সিজার বা টলেমি সিজার)। সে-ই ছিল সিজারের একমাত্র পুত্র। রোমে অবস্থিত সিজারের স্ত্রীর কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। ক্লিওপেট্রার মৃত্যুর পর কিছু সময়ের জন্য মিশরের অধিকর্তাও হয়েছিলেন সিজারিয়ান। . পম্পেই এবং অন্যান্য শত্রু দমন করতে সিজারের কয়েক বছর কেটে যায়। তবে দু’জনের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। কিওপেট্রা প্রায়ই সিজারের সাথে সাক্ষাৎ করতে যেতেন। আসলে তিনি রোমান শাসকদের সাথে সুসম্পর্ক রেখেই মিসরের স্বাধীনতা বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ সালে সিজারের অনুরোধে ক্লিওপেট্রা,পুত্র সিজারিয়ান ও তার স্বামী-ভাইকে(টলেমি-১৪) নিয়ে রোমেও যান তার জয়োল্লাস প্রত্যক্ষ করতে। রোমে সিজার ক্লিওপেট্রাকে অত্যন্ত সম্মানিত আসন দান করেন। এমনকি ভেনাসের মন্দিরে ক্লিওপেট্রার একটি স্বর্ণমূর্তিও স্থাপন করা হয়। তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, সিজারিয়ান তার ছেলে। কিন্তু এসব কিছু রোমানদের ভালো লাগেনি। এমনকি তারা মনে করতে থাকে সিজার হয়তো ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন, যদিও রোমান আইনে একই সাথে দুই স্ত্রী রাখা কিংবা বিদেশিনী বিয়ে করা নিষিদ্ধ। তা ছাড়া জুলিয়াস সিজার রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়ায় সরিয়ে নিতে চান বলেও গুজব ছড়ানো হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪ সালে তার রোমে অবস্থানের সময়েই সিনেট ভবনের বাইরে সিজার সিনেটরদের হাতে নিহত হন মাত্র ৫৫ বছর বয়সে। সিজারের আকস্মিক মৃত্যুতে ক্লিওপেট্রার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভের প্রথম প্রয়াস ব্যর্থ হয়। কেননা, মৃত্যুর আগে সিজার ক্লিওপেট্রা কিংবা সিজারিয়ানকে তার উত্তরসূরি মনোনীত করে যেতে পারেননি। ক্লিওপেট্রা মিসরে ফিরে আসেন। রোমান রাজনীতিতে তিনি নিরপেক্ষ থাকার নীতি অবলম্বন করেন। তবে রোমান রাজনীতির ওপর তীক্ষ্ম নজর রাখছিলেন। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন, যে-ই চূড়ান্তভাবে জয়ী হবে, তিনি থাকবেন তার পাশে।
Tags
Share to other apps

